পেট্রোবাংলা দাম বাড়ানোর পর গ্যাস বিক্রিতে লাভের ‘সম্ভাবনা’
সূত্র জানিয়েছে, এখন প্রতি ইউনিট (ঘনমিটার) গ্যাস সরবরাহে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন-পেট্রোবাংলার ব্যয় হয় গড়ে ১৪ টাকা। গত ১৮ জানুয়ারি সরকার দাম বাড়িয়ে দেয়, যা ১ ফেব্রুয়ারি কার্যকর হয়েছে। এতে নতুন গড় দাম দাঁড়িয়েছে ২১ টাকা ৬৭ পয়সা। ফলে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ইউনিট গ্যাসে পেট্রোবাংলার লাভ থাকছে প্রায় আট টাকা।
দাম বাড়ানোর পরও গ্যাস বিক্রিতে লোকসান হবে। সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে।নসরুল হামিদ, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী
অবশ্য জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলছে, তারা বেশি দামে খোলাবাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়াবে। সে জন্যই গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস বিক্রিতে পেট্রোবাংলার লাভ হবে, দাবিটি মোটেও ঠিক নয়। গ্যাসের ইউনিটপ্রতি গড় ব্যয় ৩০ টাকার মতো। সার উৎপাদনসহ কয়েকটি খাতে খুবই কম দামে গ্যাস দেওয়া হয়। বাড়তি দাম নেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ, শিল্পসহ কয়েকটি খাত থেকে। তিনি বলেন, দাম বাড়ানোর পরও গ্যাস বিক্রিতে লোকসান হবে। সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে।
প্রতিমন্ত্রী জানান, খোলাবাজার থেকে কিনে বছরে ছয় কার্গো (এলএনজিবাহী জাহাজ) গ্যাস আনার লক্ষ্য আছে সরকারের। দাম কমলে আরও আনা হবে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় সর্বশেষ দফায় বৃহৎ শিল্পে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা, শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের (ক্যাপটিভ) জন্য ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা, মাঝারি শিল্পের জন্য ১১ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের জন্য ১০ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা এবং বাণিজ্যিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা ৫০ পয়সা করেছে। গড়ে বেড়েছে প্রায় ৮২ শতাংশ। আবাসিক, সার কারখানা ও চা-বাগানের ক্ষেত্রে দাম বাড়ানো হয়নি।
যেহেতু বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে, সেহেতু মন্ত্রণালয়ের দাবি যাচাই করার সুযোগ নেই।ম তামিম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে নির্বাহী আদেশে, অর্থাৎ মন্ত্রণালয় নিজেই বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গণশুনানি করে মূল্য সমন্বয় করলে আমদানি খরচসহ সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা হতো।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে, সেহেতু মন্ত্রণালয়ের দাবি যাচাই করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাজারে বর্তমান দাম থাকলে এবং সেই দামে ছয়টি কার্গো আমদানি করা হলে আমার ধারণা, পেট্রোবাংলার লোকসান হবে না।’
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা পেট্রোবাংলা দেশে গ্যাস সরবরাহের কাজটি করে। দেশে গ্যাসের চাহিদা ধরা হয় দিনে ৩৮০ কোটি ঘনফুট। ৩১০ কোটি ঘনফুটের মতো সরবরাহ সম্ভব হলে শিল্পকারখানা ঠিকমতো চলতে পারে। যদিও সরবরাহ হচ্ছে ২৭০ কোটি ঘনফুটের মতো। গ্যাসের উৎস দুটি-দেশের ভেতরে থাকা গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলন ও আমদানি। আমদানির ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় গ্যাস কেনা হয়। আবার খোলাবাজার থেকেও কেনে সরকার। যদিও দাম বেড়ে যাওয়ায় গত জুলাই থেকে খোলাবাজারের এলএনজি কেনা বন্ধ রয়েছে।
পেট্রোবাংলার দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ওমান ও কাতার থেকে আনা প্রতি ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) গ্যাসের দাম এখন ১১ ডলারের মতো পড়ছে। দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে সমন্বয় করার পর ইউনিটপ্রতি (ঘনমিটার) ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ১৩ থেকে ১৪ টাকা। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এই গ্যাস গড়ে প্রায় ২২ টাকা দরে বিক্রি করা শুরু হয়েছে।
সংকট মোটামুটি কাটাতে খোলাবাজার থেকে কিনে মাসে চারটি করে কার্গো জাহাজে গ্যাস আমদানি করা দরকার। সরকার ফেব্রুয়ারিতে একটি কার্গো আমদানির দরপত্র ডেকেছে। যেখানে প্রতি এমএমবিটিইউ ১৯ দশমিক ৭৪ ডলার দাম পড়েছে। এলএনজির দাম গত বছরের দ্বিতীয় ভাগে ৬০ ডলারে উঠেছিল। বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস বলছে, ২০২৩ সালে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা কম।
সূত্র জানিয়েছে, দৈনিক এখন গড়ে ৭ কোটি ৮০ লাখ ঘনমিটার গ্যাস বিক্রি করছে পেট্রোবাংলা। এতে দিনে তাদের লাভ হতে পারে ৫৪ কোটি টাকা। মাসে এটি দাঁড়াতে পারে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে এক কার্গো এলএনজি খোলাবাজার থেকে কিনতে হলে খরচ হবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। খোলাবাজার থেকে কিনে এলএনজি যত কম আমদানি করবে, পেট্রোবাংলার লাভ ততটাই বাড়বে।
গ্যাসের নতুন দামে লাভ হবে কি না, তা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলছেন না পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, সামনে এলএনজির দাম কোথায় যাবে, তার পূর্বাভাস করা কঠিন। তাই মুনাফার কথা এখনই বলা যাচ্ছে না। হিসাব করে দেখতে হবে। আগের লোকসানের চাপও আছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গত জুনে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সময় পেট্রোবাংলার আয়-ব্যয় হিসাব করেছিল। তখন খোলাবাজারের এলএনজির দাম ২৪ ডলার ও প্রতি মাসে একটি করে কার্গো আমদানি ধরে হিসাব করা হয়েছিল। বিইআরসির হিসাবে বলা হয়েছিল, প্রতি ইউনিট গ্যাসে পেট্রোবাংলার গড় ব্যয় দাঁড়াবে ১২ টাকা ৬৮ পয়সা।
সূত্র বলছে, নতুন দামে গ্যাস বিক্রিতে যে লাভ হবে, তা দিয়ে আগের দেনা মেটাতে চায় পেট্রোবাংলা। কারণ, তারা টাকার অভাবে নিয়মিত বিল ও কর পরিশোধ করতে পারছে না।
দেশে ২০১৮ সাল থেকে গ্যাস আমদানি শুরু হয়। অভিযোগ রয়েছে, দেশে গ্যাস উত্তোলনে জোর না দিয়ে সরকার আমদানির ক্ষেত্র তৈরি করেছে। গ্যাস আমদানি করতে গিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। শুধু গ্যাস নয়, গত মাসে দুই দফায় ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এর আগে ২০১৯ সালে দৈনিক ৮৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানির কথা বলে গ্যাসের দাম ৩২ শতাংশের কিছু বেশি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু পরে সরকার আমদানি ততটা করেনি। ২০২২ সালের জুনে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় প্রায় ২৩ শতাংশ।
ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, খোলাবাজার থেকে গ্যাস আমদানির কোনো মানে হয় না। ওই পরিমাণ গ্যাস সহজেই দেশে উত্তোলন সম্ভব
Comments
Post a Comment